লিখেছেনঃ জ্যাক নোরিস, নির্বাহী পরিচালক
ভিগান হবার শুরুর সময়ে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হবে, তা বোঝা কঠিন হতে পারে। আধুনিক প্রাণীকৃষি ব্যবস্থায় প্রাণীদের উপর কতোটা জুলুম করা হয় তা জানার পর, আপনিও হয়তো চাইবেন এসব তথ্য পরিচিত মানুষদেরকেও জানাতে যাতে, তাঁরাও প্রাণীদের সাথে হওয়া এসব অবিচারের বিরুদ্ধে আপনার পাশে দাঁড়াতে পারেন।
আপনি ভাগ্যবান হলে আপনার পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবরা আপনার ভিগান হবার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবে এমনকি অনেকে আপনার সাথে যুক্তও হতে পারে! কিন্তু এটাও সম্ভব যে আপনার পরিবারের কেউ কেউ ভিগান হওয়াকে তাদের জীবনযাপন, ধর্ম বা মৃত আত্মীয়স্বজনদের স্মৃতির অপমান হিসেবে দেখবে যারা হয়তোবা শিকার করতো বা মাছ ধরতে পছন্দ করতো।
এসব ক্ষেত্রে আসলে তাদের কী বলতে হবে সেটা জানা কিছুটা কঠিন হতে পারে। কাউকে কোন কিছু করতে বাধ্য করলে সে অনেক তাড়াতাড়ি সেটা প্রতিরোধ করতে চাইবে বা বাধা দিবে, আর এটা বিশেষ করে পরিবারের লোকজনের ক্ষেত্রেই বেশি সত্যি। এজন্য অনেক ভিগানই দেখেছে যে সবচেয়ে ভালো পন্থা হচ্ছে নিজেকে একটা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং অপেক্ষা করা বাকিরা কখন এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো জানতে চাইবে তাদের কাছে।
প্রাণীজ উপকরণ বনাম বাস্তবসম্মতভাবে যথাসম্ভব ভালো কাজ করা
যখন প্রথম প্রথম আপনি ভিগান হন তখন এরকম একটা তাড়না অনুভব করা স্বাভাবিক যে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সামনে এটা প্রমাণ করতেই হবে যে প্রাণীজ কোন প্রোডাক্ট না ব্যবহার করে বেঁচে থাকা সম্ভব।
এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে ভিগান দর্শন এর উদ্ভব খুবই সাম্প্রতিক। যদিও ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন মানূষ প্রাণীদের প্রতি দয়াশীল হবার বার্তা প্রচার করে গেছেন, কোন সমাজই সম্পূর্ণভাবে ভিগান ছিলনা। ঐতিহাসিকভাবে প্রাণীদের নানাক্ষেত্রে ব্যবহারের কারণে তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি নানারকম পণ্য দিয়েই আমাদের পৃথিবী চলছে এবং তাই আপনার জীবন থেকে প্রাণী উপাদান সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা একটি অবাস্তব পরিমাণের চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এখনকার সময়ে এটা গুরুত্বপূর্ণ না যে কাউকে একশ ভাগ প্রাণীজ পণ্য বর্জন করে চলতে হবে। বরং প্রয়োজন সেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া, যাতে সমাজ প্রাণীদের ব্যবহার করা থেকে দূরে সরে আসে।এরকম একটা কথাও প্রচলিত রয়েছে যে ভিগানদের ৯৯ ভাগ ভিগান হওয়া উচিত এবং যে অতিরিক্ত সময় ও শক্তিটা একটা নিখুঁত ভিগান হতে ব্যয় হতো সেটা অন্যদের ভিগান হতে উৎসাহিত করতে কাজে লাগানো উচিত।
এমনকি প্রথমেই একেবারে শতভাগ ভিগান হবার প্রচেষ্টা আপনার অন্যদের ভিগান হতে উৎসাহিত করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কারণ অনেকের কাছে ভিগানিজমকে তখন ভীষণ কঠিন কোন সংযম মনে হতে পারে। কাউকে ভিগান হবার পথে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে শুরু করবার একটা ভালো উপায় হচ্ছে এটা দেখিয়ে দেয়া, যে প্রাণীজ পণ্য বর্জন করার প্রক্রিয়া হয় নিখুঁত হতে হবে নাহলে সেটা কিছুই না- ব্যাপারটা এরকম কিছু না।
এটা করার কিছু কার্যকর উপায় হলোঃ
- বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে রেস্তরাঁয় খেতে গেলে স্টাফদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপকরণ নিয়ে জিজ্ঞাসা না করে মোটামুটি ভিগান মনে হচ্ছে এমন খাবার খেয়ে নেয়া।
- যদি কেউ বলে যে আমি কখনো ভিগান হতে পারবোনা কারণ আমি … ছাড়তে পারবনা (তাদের সবচেয়ে প্রিয় কোন প্রাণীজ খাবার), তাহলে তাদের সেটা বাদ দিয়ে অন্য সব প্রানীজ খাবার ছাড়তে বলুন।
- কেউ সামান্য পিছিয়ে গেলেই তাকে বাতিল হিসেবে ধরা যাবেনা- প্রতিটা দিনই আরেকটা নতুন দিন যখন কেউ প্রাণীদের ভালো রাখার জন্য নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করতে পারে।
কিছু ভিগান কর্মীরা বলেন, একটা অটল বার্তা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষদের প্রাণীদের প্রতি একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে এবং যেকোন অবস্থায় প্রাণীজ উপকরণ ব্যবহার করা ভুল। এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এসব বিষয়ে নমনীয়তা সমাজকে এমন একটা জায়গায় পৌছে দিতে আরো বেশি সহায়ক হবে, যেখানে প্রাণীদের আর শোষণ করা হবেনা ।
নিজের যাত্রাটির কথা মনে রাখুন
মাঝে মাঝে যখন কেউ ভিগান হয় তার বুঝতে একটু সমস্যা হয় যে অন্যরাও কেন তার মতো হচ্ছে না। আমরা যখন প্রাণীদের প্রতি শোষণ এর মতো কিছু সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হই তখন মাঝে মাঝে এটা মনে করা কঠিন হয় যে আমরাও একময় বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম এবং হয়তো অনেক সময় জানতেও চাইনি।
ভিগানিজম এর পথে আমাদের স্বকীয় যাত্রার কথা মনে করলে আমরা তৎক্ষণাৎ অন্যর কার্যক্রম এর বিচারক হয়ে যাবো না এবং নন ভিগানদের সাথে নিজেদের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। কেউই নিখুঁত না, এবং আমাদের লক্ষ্য যদি হয় প্রাণীদের প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা, তাহলে অবশ্যই আমাদের কাউকে পরিবর্তনের জন্য উৎসাহিত করার সময় বিনয় ভাব বজায় রেখে চলতে হবে।
রাগী ভিগান ব্যক্তিত্ব কী দীর্ঘসূত্রে পরিবর্তন আনতে সহায়ক?
ভিগানদের অবশ্যই অধিকার আছে প্রাণীদের সাথে হওয়া আচরণ এর জন্য রাগ অনুভব করার। রাগ এবং ত্বরা শক্তিপালী প্রভাবক হতে পারে যেটা আমাদের প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করতে প্রেরণা দেবে। কিন্তু এটাও বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে নন ভিগানরা তখনই ভিগান হতে চাইবে যদি তারা বিষয়টাকে রাগের বদলে সুখকর কিছুর সাথে মেলাতে পারে। একারণে, নন ভিগানদের আশেপাশে আমরা যে পৃথিবীটাকে আরো মানবিক করতে পারছি সেটা নিয়ে খুশি এবং সন্তুষ্টিই প্রকাশ করাই সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
একটা প্রচলিত প্রশ্ন হচ্ছে কতটা সময় পর পর প্রাণী অধিকার বিষয়ক পোস্ট ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে দেয়া উচিত। প্রাণীদের সাথে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে দেবার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অবশ্যই ভালো প্রচারের মাধ্যম। কিন্তু খুব বেশি পোস্ট দিলে হয়তো আপনার বন্ধুরা সেগুলো দেখা বন্ধ করে দিতে পারে। এ সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে পোস্টগুলো একটু কৌশল অবলম্বন করে দিতে হবে যাতে বিষয়গুলো নিয়ে তাদের আগ্রহ তৈরি হয় কিন্তু আবার খুব বিরক্তি বা মানসিক চাপের সৃষ্টি না হয়।
যখন একটু চাপ দিলে কাজে লাগতে পারে
ভালো উদাহরণ হতে গিয়ে কাউকে চাপ দেয়া যাবেনা-এ নিয়মের এক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। যদি কেউ আপনি ভিগান হবার কারণে আপনাকে নিয়ে মজা করতে থাকে তাহলে তাদেরকে ভিগান বানানোর চেষ্টা করে জিনিসটা সেখানেই শেষ করে দেয়া যাবে। যদি তারা আপনাকে তাচ্ছিল্য করতে থাকে আপনি তাদেরকে বলতে পারেন ভিগানিজম বিষয়ক ভিডিও দেখতে, পুস্তিকা, বই এবং প্রবন্ধ পড়তে। কয়েকবার এটা করলে ভালো একটা সম্ভাবনা রয়েছে যে তারা আর এ বিষয়টা তুলবেই না।
উপসংহার
ভিগানিজম একটা তুলনামুলক নতুন দর্শন এবং আমরা সংখ্যায় খুব কম এটা বুঝলেই আমরা সম্মান ও বিনয়ের সাথে আরেকজনের সঙ্গে ভিগানিজম বিষয়ক কথা বলতে পারবো এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে সক্ষম হব। নিজে একজন ইতিবাচক উদাহরণ হওয়া এবং পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের সামনেও ভিগানিজমের একটা সহজ ও অর্জনযোগ্য চিত্র উপস্থাপন করলে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আর যদি আপনি অন্যদের জীবনে আরো বড় ভূমিকা রাখতে চান, তাহলে ভিগান আউটরিচ এর একজন সেচ্ছাসেবক কিংবা ডোনার হতে পারেন!